তোমার আমার ঠিকানা শাহবাগের মোহনা_ এই স্লোগানে উত্তাল গণজাগরণের কারিগর
প্রজন্মের তরুণরা শাহবাগে নির্ঘুম জেগে থাকো। 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা
মেঘনা যমুনা'_ বীর বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই স্লোগানে নতুন করে
বুকের ভেতরে জমে থাকা ৪০ বছরের বেদনা ও ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছ সবখানে সব
পথে। সারা দেশ আজ শাহবাগের মোহনায়। '৭১-এর রণাঙ্গনের রক্তে নাচন ধরানো 'জয়
বাংলা' স্লোগান তোমরা তুলে দিয়েছ ফের মানুষের মুখে মুখে। জাতীয় ঐক্যের
মোহনা আজ শাহবাগ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া আর সুন্দরবন থেকে সুনামগঞ্জ
পর্যন্ত সব কণ্ঠে এক সুরের ঢেউ খেলছে। কাল বসন্তে রং দোলা খেয়েছে শাহবাগের
মোহনায়। আজ ভালোবাসা দিবসে দেশপ্রেমের সুর উঠবে পথে-প্রান্তরে মানুষের
হৃদয়ে হৃদয়ে। প্রিয় মাতৃভূমির নামে লাখো শহীদের রক্তের ঋণে স্লোগান উঠেছে
ঘরে ঘরে। হে প্রিয় প্রজন্ম, তোমরা চোখ-কান খোলা রেখে তোমাদের লক্ষ্য
অর্জনের পথে ইস্পাতকঠিন এ ঐক্য সুসংহত রেখো। কোনো দল বা ব্যক্তির হাতে যেন
এই শক্তি চলে না যায়। তোমরা গণমানুষের হয়ে কথা বলছ। বল। তোমরা কবি নজরুলের
বাবরি দোলানো চুল ঝাঁকিয়ে বল, 'বল বীর বল উন্নত মম শির'। আরও চিৎকার করে বল
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। এত সুন্দর ছন্দময় আন্দোলন অতীতে দেখেনি বিশ্ব।
তোমাদের পূর্বসূরিদের প্রতিটি সংগ্রাম ছিল রক্তক্ষয়ী। সেনাশাসক থেকে
স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে পুলিশের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাসের
মুখোমুখি হতে হয়েছে। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক গণহত্যার নেশা নিয়ে
তোমাদের প্রতি এগিয়ে আসছে না। সেনাশাসক জিয়া-এরশাদের পুলিশ রক্তচক্ষু নিয়ে
হামলে পড়ছে না। ঘাতক ট্রাকের আনাগোনা নেই। আছে উৎসব-আনন্দ, স্লোগান-গানের
বর্ণিল ছবি। তোমরা কতই ভাগ্যবান। তোমাদের সঙ্গে পুলিশের কোনো বিরোধ নেই।
পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। সংহতি জানাচ্ছে! মহান সংসদ তোমাদের পাশে
দাঁড়িয়েছে। সংসদ নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তোমাদের প্রতি তার প্রাণ
উজাড় করা সমর্থন জানিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সর্বোচ্চ
নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি তোমাদের উচ্ছ্বাসকে স্বাগতই জানায়নি
বলেছে ক্ষমতায় এলে তারাও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অব্যাহত রাখবে।
স্বপ্নের জাতীয় ঐক্যকে তোমরা দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে হে প্রজন্ম। দলের দুই
নেতা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় দণ্ডিত অবস্থায় যে সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য হয়েছে তা এই প্রজন্মের অর্জন। এই শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ায়
বিএনপিকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ এখন বিএনপির সময়ের
ব্যাপার। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, লেখক, শিল্পী_ কে নেই তোমাদের
সঙ্গে? গোটা বাংলাদেশ তোমাদের সঙ্গে গলা ছেড়ে স্লোগান তুলছে। তিন মিনিটের
জন্য গোটা দেশ শাহবাগের মোহনাকে ঠিকানা করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। এ যে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রিয় প্রজন্মের ডাকে সবার ঘুম ভেঙেছে। হে প্রজন্ম,
তোমরা সবার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছ। একটি জাতিকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছ। তোমাদের
ডাকে আজকের বীর বাঙালির ঐক্য হঠাৎ করে সৃষ্টিই হয়নি, একটি জাতির
নেতৃত্বদানে যারা ভুল করে আসছিলেন, যারা শাসকের মূর্তি নিয়ে দীর্ঘ পথ
হেঁটেছিলেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য এই গণজাগরণের বিকল্প কিছুই ছিল না।
হে প্রিয় প্রজন্ম, তোমারা এখন গোটা দেশের শক্তিই নও, তোমাদের বিজয় এখন
দ্বারপ্রান্তে। রাত যত বাড়ছে গণঐক্য তত মজবুত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভুলে
গেলে চলবে না, অতীতে আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করলেও তা ছিনতাই
হয়েছে। লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। নানা ষড়যন্ত্রের চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে। জাতি
হতাশ, ক্ষুব্ধ হয়েছে বার বার। তবুও প্রতিবাদী হতে পারেনি। রাজনীতি দিন দিন
মূল্যবোধহীন হয়েছে। এই অবক্ষয়ের মূল্যবোধহীন গণবিরোধী রাজনীতির ধারা
শাহবাগের মোহনা থেকে তারুণ্যের ডাকে বদলে দিতে হবে। রাজনীতিতে আত্দশুদ্ধি,
আত্দসমালোচনা ও আত্দসংযমের দুয়ার খুলে দিতে হবে। হে প্রিয় প্রজন্ম, অসুস্থ
রাজনীতির পথে আসা প্রতিহিংসার রাজনীতির পাশাপাশি দুর্নীতি যে সর্বগ্রাসী
রূপ নিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের আত্দার ক্রন্দন হৃদয়ে নিয়ে এর
বিরুদ্ধে এই গণজাগরণ থেকে আঘাত হানতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী দালাল,
সুবিধাবাদী, বর্ণচোরা মানুষদের থেকে সজাগ-সতর্ক থাকার এখনই সময়।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবির সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি ও শোষণ মুক্ত
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার ডাক এই গণজাগরণ থেকেই শক্তভাবে আসতে হবে। আমাদের
ভুললে চলবে না, শেয়ার কেলেঙ্কারি ৩২ লাখ বিনিয়োগকারীকে কীভাবে
রিক্ত-নিঃস্ব করেছে। ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টের আলোকে অর্থমন্ত্রীর
মুখ দিয়ে উচ্চারিত ক্ষমতাবানদের বিচারের কাঠগড়ায় আনার ডাক এখান থেকেই দিতে
হবে। হে প্রিয় প্রজন্ম, তোমাদের পূর্বসূরিদের রক্তগঙ্গায় যে বাংলাদেশের
বিজয়ের সূর্য উদিত হয়েছিল, সেখানে যারা প্রশাসনের ভেতরে থেকে বার বার ফাইল
ঠেকিয়ে পথে পথে ঘুষবাণিজ্যকে সংস্কৃতিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; তাদের বিরুদ্ধে
এই গণজাগরণ থেকেই অসীম সাহস নিয়ে কথা বলতে হবে। মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
কয় টাকা মাইনে পেয়ে সরকারি কর্মকর্তা, প্রকৌশলী থেকে ওয়াসার পরিদর্শক আর
পিডিবির বিল কালেক্টররা বিত্তবৈভব আর বিলাসী জীবনে গা ভাসান? এরা কারা?
এদের চেহারা উন্মোচন করে দিতে হবে। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোল হে প্রজন্ম। যারা চোরাকারবারি, যারা সিন্ডিকেট
করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়, যারা টেন্ডার বাণিজ্য করে, যারা গরিব দেশের
হাসপাতালের সেবা নির্বাসনে দিয়ে লুটপাট করে তাদের বিরুদ্ধে কথা বল হে
প্রজন্ম।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান সংগঠক থেকে শুরু করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা
তোমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ভাষাসংগ্রামী থেকে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক
এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারাও এই অগি্নস্ফুলিঙ্গ দেখে
তোমাদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। সেনাশাসন-বিরোধী আন্দোলনের পথের সাথীরাও নেমে
এসেছেন রাজপথের মোহনায়। আলেমরাও বসে থাকেননি। হে প্রজন্ম, তাদের প্রতি
সম্মান রেখে তোমরা তোমাদের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাও। তোমাদের বার বার
অভিবাদন। তোমরা আমাদের লাখো শহীদের হয়ে আজ বাংলাদেশকে জাগিয়ে দিয়েছ। আমাদের
সম্ভ্রমহারা মা-বোনের হয়ে নিরন্তর স্লোগান তুলছে স্লোগানকন্যারা। স্কুল
থেকে ছুটে আসা বালিকারা তালে তালে সুরে সুরে হৃদয় উজাড় করা সমর্থন
জানাচ্ছে। বীর বাঙালির এই প্রজন্ম তোমরা বন্ধ্যা নদীকে খরসে াতা করে দিয়েছ।
এই ঊর্মিমালা ষাটের উত্তাল দিনগুলোতে, সত্তরের নির্বাচনে, একাত্তরের
মার্চে জাতি দেখেছে। এত যুগ পর তোমরা যে তর্জনি তুলেছ তার নাম বাংলাদেশ।
তোমরা একেকজন এই জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনি হয়ে
দাঁড়িয়ে গেছ। তোমরা একেকজন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর প্রতিবাদী
সংগ্রামের মুখ হয়ে দেখা দিয়েছ। তোমাদের মাঝে আজ গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিচ্ছবি। তোমরা যেমন করে তোমাদের পূর্বপুরুষদের
বীরত্বের অমলিন স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে এই গণজাগরণ ঘটিয়েছ স্বাধীনতা অর্জনের
৪২ বছর পর, তেমনি আজ থেকে ৫০ বছর পর অনাগত প্রজন্ম তোমাদের এই বীরত্বের
গল্প আরেক প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেবে। তোমরা নিজেরাই জান না তোমাদের উচ্চতা
কোথায় নিয়ে গেছ। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি গভীর আস্থা,
সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি কোনো রাগ-অসন্তোষ না দেখিয়ে যে জাগরণ ঘটিয়েছে তা
যে ইতিহাস। তোমরা আজ ইতিহাসের বীর সন্তান। তোমাদের এই শক্তি আজ বাংলাদেশকে
যুদ্ধাপরাধ বিচারের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্তই করবে না, তোমাদের এই শক্তির
ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শোধরানোর পথ দেখিয়ে দেবে। তাই
কোনো হঠকারিতা, উসকানি, কারও পাতা ফাঁদে পা না দিয়ে যেভাবে তোমরা কথা বলছ
সেভাবেই বলে যাও। এই সংগ্রাম বৃথা যেতে পারে না। হে প্রজন্ম, তোমাদের বিজয়
অনিবার্য। জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গতকাল বৈঠক করে
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের সদস্যপদ
বাতিল করেছেন। তাদের অভিবাদন। এটা এই প্রজন্মের অর্জন। গণতন্ত্রের
আইল্যান্ড খ্যাত জাতীয় প্রেসক্লাব গতকাল কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।